শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৬:৫৭ অপরাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বা প্রতিরক্ষাপ্রধান বিপিন রাওয়াত, তার স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াতসহ ১২ সামরিক কর্মকর্তা বহনকারী সর্বাধুনিক সামরিক হেলিকপ্টারটি কী কারণে বিধ্বস্ত হয়েছিল তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
এদিকে, দিল্লির সেনা ছাউনিতে শুক্রবার বিকেলে প্রয়াত প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়ক জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং তার স্ত্রী মধুলিকার শেষকৃত্য হবে।
বিধ্বস্ত সামরিক হেলিকপ্টারটিতে বিপিন রাওয়াতের স্ত্রী, সামরিক কর্মকর্তা ও ক্রুসহ মোট ১৪ যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু নিশ্চিত করে ভারতীয় বিমান বাহিনী। এ ঘটনায় বেঁচে থাকা একজন এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
বুধবার দুপুরে মাঝ আকাশে ভেঙে পড়ে ভারতীয় সেনার এমআই-১৭ হেলিকপ্টার। গুরুতর জখম রাওয়াতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। সেখানে মৃত্যু হয় দেশের প্রথম প্রতিরক্ষাপ্রধানের।
দুর্ঘটনা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ
এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে কাটাছেড়া, ওঠে এসেছে নানামুখি প্রশ্ন ও সন্দেহ।
রাওয়াতের মতো হাই-প্রোফাইল সেনা কর্মকর্তাদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হেলিকপ্টারে সুরক্ষা ব্যবস্থা কতটা থাকে? সেগুলি কী এভাবে দুর্ঘটনার মুখে পড়তে পারে?
প্রথমে মনে করা হয়েছিল, হাইটেনশন তারে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ার পর আগুন লেগে গিয়েছিল হেলিকপ্টারটিতে। তবে যত সময় এগোচ্ছে, তত সেই তত্ত্ব হালকা হয়ে আসছে। কারণ, প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ দাবি করছেন, তারা আকাশেই হেলিকপ্টারটিতে আগুন লেগে যেতে দেখেছেন। এরপর জ্বলন্ত হেলিকপ্টারটি মাটিতে আছড়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, প্রয়াত প্রতিরক্ষাপ্রধান বিপিন রাওয়াত যে হেলিকপ্টারটিতে ছিলেন, সেটি এমআই-১৭-ভি-৫ মডেলের। এমআই সিরিজ়ের সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার হল এই এমআই-১৭-ভি-৫। বহুবিদ কাজে ব্যবহার করা যায় এই হেলিকপ্টার। তাই এর চাহিদাও অনেক বেশি।
২০০৮ সালে রাশিয়া থেকে কেনার জন্য ৮০টি এমআই -১৭-ভি-৫ হেলিকপ্টার অর্ডার দিয়েছিল ভারত। ২০১১ থেকে হেলিকপ্টারগুলো একে একে ভারতে আসতে শুরু করে। ২০১৮-র মধ্যেই ভারতে চলে আসে সবকটি হেলিকপ্টার।
রাশিয়া থেকে যে হেলিকপ্টারগুলো ভারত পেয়েছে, তার মধ্যে সর্বাধুনিক হল এই ভি-৫ মডেল। সাধারণত এই ধরনের হেলিকপ্টারগুলোতে ডাবল ইঞ্জিন থাকে। অর্থাৎ, যদি ছোটখাটো কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ হয়, বা যদি একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়, তাহলে তা সামাল দেয়ার জন্য বিকল্প একটি ইঞ্জিন থাকে। সেই কারণে শুধু প্রতিরক্ষা প্রধানই নন, আরও যারা শীর্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন… এমনকী প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো ভিভিআইপিরা এই ধরনের চপার (হেলিকপ্টার) ব্যবহার করে থাকেন।
কিন্তু তারপরেও বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর অধরা থেকে যাচ্ছে।
সেনা কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করছেন, দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে দৃশ্যমানতার অভাব। কারণ দৃশ্যমানতা কম হয়ে গেলে, তা হেলিকপ্টার পাইলটের কাছে এক বিভীষিকার সমান।
বুধবার নীলগিরির যে অংশের ওপর দিয়ে এই হেলিকপ্টারটি যাচ্ছিল, সেই এলাকায় দৃশ্যমানতা অনেকটাই কম থাকে। এছাড়া বিগত কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া খারাপ ছিল। সেই কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু যে হেলিকপ্টারে প্রতিরক্ষা প্রধানের মতো হাই প্রোফাইল সামরিক কর্মকর্তা যাচ্ছেন, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা অনেক আঁটসাঁট থাকে।
এই ধরনের ক্ষেত্রে কোনও হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি যখন হেলিকপ্টারে চড়েন, তখন সেটির প্রযুক্তিগত কোনও সমস্যা রয়েছে কিনা, তা উড্ডয়নের আগে একাধিকবার পরীক্ষা করা হয়ে থাকার কথা। বিমান বাহিনীর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে এই বিষয়টি।
এছাড়া আজকের উড্ডয়নটি যখন আগে থেকেই নির্ধারিত, তখন তা নিশ্চয়ই একাধিকবার পরীক্ষা করা হয়েছে। তারপরেও কেন এমন দুর্ঘটনা? প্রশ্ন অনেকের।
প্রাথমিকভাবে দুটি তত্ত্ব উঠে আসছে – যান্ত্রিক গোলযোগ বা দৃশ্যমানতার অভাব। আর তার সঙ্গে অবশ্যই আরও একটি তত্ত্ব উঠে আসছে। অন্তর্ঘাত কিংবা নাশকতার তত্ত্ব।
বিমান বাহিনী ইতিমধ্যেই গোটা ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
কী বলছেন ভারতীয় বিমান কর্মকর্তা
এই দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে, দেশের প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়কের হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ল কী করে? উত্তর খুঁজতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার যোগাযোগ করে বিমানবাহিনীর সাবেক গ্রুপ ক্যাপ্টেন রমেশকুমার দাসের সঙ্গে।
রাওয়াতের হেলিকপ্টার ওয়েলিংটন যাওয়ার পথে নীলগিরি পাহাড়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে ওয়েলিংটনের ওই স্টাফ কলেজেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন রমেশ। তাই ওই এলাকা এবং নীলগিরি পাহাড়ি এলাকা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো বলে জানান তিনি।
ওয়েলিংটনের ডিফেন্স স্টাফ কলেজে নিয়মিত বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তারা বক্তৃতা দিতে আসেন, বলে জানান রমেশ। সিডিএস বিপিন রাওয়াতও ওই কলেজেই বক্তৃতা দিতে সুলুর থেকে রওনা দিয়েছিলেন। দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট নাগাদ নীলগিরি পাহাড়ে, কুন্নুরের জঙ্গলে ভেঙে পড়ে তার হেলিকপ্টার।
খারাপ আবহাওয়াকে অনেকেই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করছেন। তবে একাধিক কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন রমেশ। তিনি বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই তামিলনাড়ুর আবহাওয়া খারাপ। নীলগিরি পাহাড়ে আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মেঘলা বা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যায়। হেলিকপ্টার টেক-অফ করার পর হয়তো আবহাওয়া খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই খারাপ আবহাওয়ার বিষয়টি একে বারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। দুর্ঘটনার কারণ খোঁজার সময় এটাও নিশ্চয় তদন্ত করে দেখা হবে।’
যদিও দেশের প্রতিরক্ষাপ্রধানের মতো ভিআইপি-দের আকাশ পথে যাতায়াতের সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাসের দিকেও বিশেষ নজর দেয়াই নিয়ম।
সুলুর এয়ারবেস থেকে ওয়েলিংটন যেতে আকাশপথে ২০ মিনিটের মতো সময় লাগে বলে জানান রমেশ। নীলগিরির পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে এই পথ। তার মতে আবহাওয়ার সঙ্গে এলোমেলো হাওয়ার ফলে সেই সময় হেলিকপ্টারটি কোনও বিপদে পড়েছিল কী না সেটিও দেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, “হেলিকপ্টারে একাধিক ‘মুভিং পার্টস’ থাকে। হেলিকপ্টারের মাথার ওপর যেমন ব্লেড ঘোরে, তেমনই থাকে ‘টেল রোটার’ অর্থাৎ হেলিকপ্টারের পিছনে বা লেজের দিকে পাখা ঘুরতে থাকে। পাহাড়ে বিভিন্ন মুখী হাওয়া চলে। কখনও উপর দিক থেকে নীচের দিকে, কখনও নীচ থেকে উপরে হাওয়া ওঠে। অনেক সময় এর হঠাৎ তারতম্য ঘটলে অসুবিধায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে।”
একই সঙ্গে রমেশ এটাও জানান যে, এই সব বিষয়গুলো বিমান কর্মকর্তা ও পাইলটরা মাথায় রাখেন। কী ধরনের সমস্যার মুখে তারা পড়তে পারেন তা সম্পর্কেও ধারণা থাকে তাদের।
রুশ এমআই-১৭ দেশের অন্যতম অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট উল্লেখ করে রমেশ বলেন, “যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হেলিকপ্টারে ওঠার আগে সেই হেলিকপ্টারের একাধিক পরীক্ষা করা হয়। ‘সার্ভিস এবিলিটি’ অর্থাৎ পরীক্ষার সঙ্গে যন্ত্রাংশ খুঁটিয়ে দেখা হয়।’’
তিনি বলেন, ‘কোনও এয়ারবেসের স্কোয়াড্রনে যত এয়ারক্রাফট থাকে তার মধ্যে সব থেকে ভালটাই ব্যবহার করা হয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের বহনের কাজে। অভিজ্ঞ পাইলটই সেই হেলিকপ্টারের চালকের আসনে থাকেন।’
শুক্রবার শেষকৃত্য
দিল্লির সেনা ছাউনিতে শুক্রবার বিকেলে প্রয়াত প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়ক জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং তার স্ত্রী মধুলিকার শেষকৃত্য হবে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে তামিলনাড়ুর সুলুর বিমানঘাঁটি থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ উড়োজাহাজে জেনারেল রাওয়াত এবং তার স্ত্রী মধুলিকার মরদেহ দিল্লিতে আনা হবে। এরপর দু’জনের মরদেহ রাখা থাকবে রাওয়াতের বাড়িতে।
সেনা বাহিনীর বরাতে জানানো হয়েছে, শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত প্রয়াত প্রতিরক্ষা সর্বাধিনায়কের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন তার অনুরাগীরা। এরপর কামরাজ মার্গ থেকে শুরু হবে শেষযাত্রা। দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের ব্রার স্কোয়ারে অন্ত্যেষ্টিস্থলে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় হবে শেষকৃত্য।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অপূরণীয় ক্ষতি
সস্ত্রীক জেনারেল বিপিন রাওয়াতের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ভারতের তিন প্রতিরক্ষা বাহিনীও।
প্রয়াত প্রতিরক্ষাপ্রধানকে সম্মান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাকে একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। টুইটারে লিখেছেন, ‘জেনারেল বিপিন রাওয়াত একজন অসাধারণ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। তিনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং নিরাপত্তা সরঞ্জামের আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কৌশলগত বিষয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ব্যতিক্রমী। তার মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে শোকাহত করেছে।’প্রধানমন্ত্রী আরও লিখেছেন, ‘ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষাপ্রধান হিসাবে, জেনারেল রাওয়াত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কারসহ আমাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন। সেনাবাহিনীতে কাজের একটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা তিনি পরবর্তীতে ব্যবহার করেছিলেন। ভারত তার ব্যতিক্রমী সেবা কোন দিন ভুলবে না।’